Rose Good Luck পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-৩১) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৪:০৬:১৮ বিকাল

গ্রামের বাড়িতে সেই রাত! সালিশ হবার দিনের রাতটির কথা বলছিলাম।

ঐ একটি রাত নির্ঘুম কাটলো। দীর্ঘ... অপেক্ষার একটি রাত। না শেষ হওয়া দুঃসহ কিছু মুহুর্তের পীঠে চাবুক মারা অনুভূতিকে শেষ হবার ক্ষণগুলোকে নিয়ে আসা একটি ভোরের!

জেগে থেকে স্বপ্নে লাভলিকে দেখছিলাম।

এক মেঘবালিকা! যে আমাকে তার চোখ দিয়েছিল ওর হৃদয়কে অনুভব করতে। দু’টি চোখ একটা অদৃশ্য ‘স্ট্রীট ওয়ে’- যেখান দিয়ে এক কোলাহলহীন...শান্ত...অসহ্য অলস গতিতে সুখগুলোকে পাশে রৌদ্রোজ্জ্বল এক মায়াবী বিকেলে শান্ত-নিস্তব্ধ লেকের পাড়ে বসে থেকে সীমাহীন ভালোলাগাকে উপভোগ করা যেতো।

আমিই সেই সুখ স্বপ্নীল ভাবনার ডানামেলা প্রজাপতিটিকে বর্ণহীন করেছি। দৃষ্টিকটু একধরণের ছেলেমানুষিতে আসক্ত হয়েছিলাম বোধহয়। আমার কারণে জিগাড়ের আঠায় আটকে যাওয়া ঘাষ ফড়িঙ এর মত অসহায় গতিশূন্য এক চঞ্চলা হরিণী শ্লথ হয়ে পড়ল। আমিও হারালাম আমার সেই মায়াবী হ্রদকে। আমাকে লাভলীর হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করা সেই মায়াবী দৃষ্টিপথ যা একটা বিশেষ উপহার ছিল সৃষ্টিকর্তার।

ইচ্ছায় অনিচ্ছায় এভাবে হারালাম?!

সুতাটা ছিড়ে গেল।

হেরে গেলাম কি?

আজীবন নাক উঁচু স্বভাবের... বাবার আদরের ছায়ায় বড় হওয়াতে নাকটা বোধহয় আরো উঁচু হয়ে গেছিলো। তাই বুঝি এমন হল?

লাভলীর সাথে ভৈরব নদীতে নৌকায় ভেসে যেতে যেতে স্রোতের অনুকূলে থেকে ওর কথায় স্রোতের প্রতিকূলে চলবার ইচ্ছেটা জেগেছিল। সে বলেছিল-

‘ এ পথ ছেড়ে দাও।‘

‘ এই মুহুর্তে সম্ভব নয়।‘

আমার সেই ‘না’ই কি ঐ হ্রদটিকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে?

চকিতে স্বপ্নের লাভলী অদৃশ্য হয়ে যায়। ওর সেই দৃষ্টিপথ কিভাবে যেন বিস্মৃত হয়ে গেল।

মিথিলা বাবু!

ঠিক সেই মুহুর্তে আমি যেন স্পষ্ট দেখছিলাম প্রাইমারি স্কুল মাঠে নির্ভীক দাঁড়ানো মনিরের পাথরের জীবন্ত চোখ দু’টিকে। আমার দিকে নির্ণিমেষ তাকানো। পরমুহুর্তে সে দুটি খুলনায় আমার হাইস্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা বাবরের চোখে পরিণত হল। চেয়ারম্যান নুরু খলীফা থেকে সৈয়দ হাশেম আলী- এদের সকলের সাথে একাধারে উপস্থিত সবার চাওয়া-পাওয়াগুলো একত্রে দৃশ্যমান আমার দৃষ্টির প্রবেশপথে এসে দাঁড়ালো। আমি নিরন্তর কষ্টকে সাথে করে ওদের অনুভূতিগুলোর তীব্রতায় বিবর্ণ হচ্ছিলাম! আমার সমাজ-সংষ্কার-শিক্ষা-রুচি এসব কিছুকে ছাপিয়ে বোধের অগোচর কিছু ‘কেন?’ এসে হাজির হল।

এগুলোর উত্তর জানা ছিল না।

একেবারেই যে জানা ছিল না, এমনও নয়। তবে মানার শক্তি থাকলেও অবস্থার প্রেক্ষিতে কিছু কারণে ইচ্ছে এবং সাহস ছিল না। গলাকাটা আতিক এবং টাক জাহিদকে শহরে অন্যদেরকে সাথে নিয়ে ফিরে যেতে বললাম। তিন মটর বাইকে চড়ে ওরা ধূলা উড়িয়ে ফিরে গেলো। বাবা আর আমি রয়ে গেলাম।

গভীর রাতে মনিরের ঘর থেকে অবদমিত কান্নার আওয়াজ পেলাম।

বাইরে শান্ত রাত।

নিজের ঘরে অশান্ত এক যুবক।

হৃদয়ে ঝড়।

পুরো সমাজটিই কি এ সময়ে এমন ছিল না? যার যার অবদমিত কষ্টগুলো না পাওয়ার ফানুসে চড়ে মহাশূন্যে মিলিয়ে যেতে চাইলেও পারছিল না। যেভাবে মনির আজ বিকেলে প্রকাশ্যে চরম অপমানিত হয়ে নিজেকে সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল! কিন্তু ভিতরের আর্গল খুলে দিতে না পেরে জেদ আর ক্ষোভ সহ সকল অনুভূতিগুলো কি মধ্যরাতের নিশ্চুপ কান্না হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যেতে চাচ্ছে না?

ওর মনে কি চলছিল সেটা তখনই যদি জানতে পারতাম!

ভালো হতো।

সকলের জন্য।

দু’টো চরমপন্থি দলের মাঝখানে পড়ে আমাদের গ্রামটিকে দীর্ঘদিন পিষ্ট হতে হতো না।

মিথিলা বাবু!

তোমার মা ঐ রাতে জেগে জেগে দেখা স্বপ্নে আবারো এলেন। ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে বুঁদ হওয়া আমাকে চরম বাস্তবতা দেখানোর চেষ্টা করলেন। এক অজ পাড়া গাঁ এর দো’তলা টিনের ঘরে নিঃসঙ্গ একটি রুমা আমি। তোমার মা ঢাকার এক হোষ্টেলে। আর আমাদের দুই হৃদয়ের মাঝের ব্যবধানটুকু ধীরে ধীরে কাছে-দূরে হচ্ছিল কিছু চাওয়া-পাওয়াকে কেন্দ্র করে। ও চাইছিল একভাবে। আমি চলছিলাম ভিন্ন পথে। কিন্তু কার পথটি সঠিক ছিল, তখন সেটি ভাবতে পারছিলাম না। চাইছিলামও না।

আমি শুধু লাভলীকে চাইছিলাম!!

আমি চাচ্ছিলাম, আমি এখন যেভাবে আছি, এই অবস্থায়ই সে আমাকে মেনে নিক। পাশে থাকুক। হাত ধরুক। পথ চলুক। ওর হৃদয়ে আমাকে নিয়ে ভাবনার তোলপাড় হোক। পথ চলতে চলতে রাস্তার পাশের যে কোন গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলুক, ‘ একটু দাঁড়াই।‘ আগেই সে থেমে যাওয়াতে চলতি পথে হাতের টানে থেমে যাবার গতিহীন অনুভূতি আগেই পেয়েছি। এবার সম্মতি চাওয়ার দুটি শব্দ ভালোলাগার অন্য এক আমেজ নিয়ে এলো- এমনটি হোক।

ওর ঘেমে যাওয়া নাকের নীচের শ্বেত বিন্দুগুলো দুর্লভ মুক্তোর মত লাগুক- এমন একটি মুহুর্ত লাভলী আমাকে দিক। ও সাথে আছে... পথ চলায় সঙ্গী পেয়েছি... এখন কিছু করে দেখানোর চেষ্টা করতে পারি... চাইছিলাম এমন কিছু অনুভব লাভলী আমাকে এনে দিক। কিন্তু দৃশ্যমান সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের সাথে থেকে গোপন চরমপন্থি দলের রাজনৈতিক শাখার একনিষ্ঠ কর্মী হবার সুবাদে আমি চারদিক থেকে মাকড়শার জালে আটকে যাচ্ছিলাম। এর ভিতর খুলনা শহরের পরিবার কেন্দ্রিক ক্ষমতার নোংরা রাজনৈতিক বলয়ে আগে থেকেই যুক্ত ছিলাম। আর এখন এই যে নিজের গ্রামে নতুন এই বিষচক্রে এসে সাময়িক ফেসে গেলাম।

মিথিলা বাবু!

পরিবার থেকে শান্তি কিভাবে চলে যায় দেখলাম। কিছু অনুভবও করলাম। সামান্য দু’হাত জমির সীমান আইল সরানোকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সমস্যা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠে দেখলাম। গ্রামেও পরিবারকেন্দ্রিক আধিপত্য কিভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে নিজ চোখে দেখলাম। চেয়ারম্যান নুরু খলীফার মত সিস্টেমের নিম্নস্তরের বুর্জোয়া প্রতিনিধির শাসন-শোষণকেও দেখা হল। তাদের সাথে গ্রাম্য প্রভাবশালী পরিবারের মাথারা নিজেদের মধ্যবিত্ত শ্রেণিসুলভ স্বার্থবাদী আচরণের যে বহিঃপ্রকাশ সেদিনের সালিশে দেখিয়েছে- এক নতুন দিগন্তব্যাপী চিন্তা-ভাবনা আমাকে প্রচলিত পুরা সিস্টেমকে আমার সামনে উন্মোচন করে দিলো। শ্রেণি সংঘাতের এক জীবন্ত রেপ্লিকা আমার দেখা হল। আমার ভিতরের শহুরে ভাবধারার আমি নিজের শেকড় কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড্ড অসহায় পেলাম। বড্ড একা। চারদিকে নিঃসীম শূন্যতা মাঝে একাকীত্ব বড্ড বেশী বেজে উঠল!

কেবল লাভলী ই আমার এই একাকীত্বকে দূর করতে পারত।

কিন্তু সে যেভাবে পাশে থাকতে চাইছিল, তাতে আমার অন্য স্বপ্নটি ভেঙ্গে যেতো। আমিও আরো কয়েকজন দিনবদলের স্বপ্ন দেখেছিলাম। তবে আমার স্বপ্নের পথে লাভলী বাঁধা হচ্ছিল না। সে আমার অনুসরণকৃত পথটিকেই সঠিক বলে মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু ঐ সময়ে আমি যেভাবেই হোক এই পথে অনেকদূর হেঁটে এসে পড়েছিলাম। আমিও চাইছিলাম লাভলী আমার কাছে আসুক। অন্তত এতদূর পর্যন্ত কাছে আসুক। স্বপ্নপূরণে কিছু পথ সামনে এক সাথে চলুক।

তারপর না হয় ফেরা যাবে।

কিন্তু না চলেই যদি ফেরার পথ রুদ্ধ কল্পনা করে পথ চলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়, কেমন হবে? তোমার মা ঠিক এই কাজটিই করছিলেন মিথিলা বাবু।

কিন্তু কেন সেটা বুঝে আসলেও মেনে নিতে পারছিলাম না। তবে শেষ পর্যন্ত সে কাছে এসেছিল। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল কি?

সে অন্য এক গল্প। আর একদিন তোমায় শোনাবো।

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

৮১৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

303163
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৩৪
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

পড়তে পারিনি, শুধু সালাম জানিয়ে দোয়া করে গেলাম-

ব্যস্ততা কমছেনা..
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ০২:০২
245228
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

অনেকদিন পরে এলেন।
খুব ভালো লাগলো। আপনার দোয়ায় আমীন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
303209
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৫:৫১
কাহাফ লিখেছেন :
শ্রদ্ধেয় মামুন ভাই!
সালাম ও শুভেচ্ছা রইল! এতো কাছ থেকে বিষয় কে উপস্হাপন করেন আপনি,মুগ্ধতার স্রোতে ভেসে মন্তব্যের অনুভূতি রা কোথায় যেন সরেই যায়! চুপ থেকে অনুভবেই যেন প্রশান্তি!!
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বিকাল ০৫:৩১
245298
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম।
সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File